কলকাতার বনেদি বাড়ির পুজো

তিরিশ-চল্লিশ জন কুলির কাঁধে চড়ে ঠাকুর বেরোত৷ সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে বড় রাস্তায় পড়ে বাঁ দিকে সোজা হাঁটলেই গঙ্গা৷ কিন্তু গনেশ টকির মোড়ে পৌঁছে বড় জ্যাঠামশাই বলতেন বাঁ দিকে ঘুরতে৷ কয়েক পা এগোলেই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির ফটক৷ সেখানে অনর্থক আমাদের বাড়ির ঠাকুরকে বার কয়েক পাক খাওয়ানো হত৷ তারপর আবার পিছু হেঁটে এসে গঙ্গার দিকে হাঁটা৷ একবার জ্যাঠামশাইকে সাহস করে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, ফি বছর আমরা ওদিকে যাই কেন? সোজা গঙ্গার দিকে গেলেই তো হয়! জ্যাঠামশাই বললেন, বুঝলি না! ওই ঠাকুরবাড়ি আমাদের সঙ্গে একদিন পুজোয় টক্কর নিতে গিয়েছিল৷ তাই ওদেরই নাকের সামনে দিয়ে ...৷

যদিও জোড়াসাঁকোর দাঁ বাড়ির দেখাদেখি ঠাকুরদের শুরু করা পুজো দু-চার বছর হয়েই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল৷ হাসতে হাসতে বলছিলেন অসীমচন্দ্র দাঁ৷ শিবকৃষ্ণ দাঁয়ের পরিবারের ষষ্ঠ পুরুষ৷ ইনি সেই ধনকুবের শিবকৃষ্ণ দাঁ, কুলীন ব্রাক্ষ্মণদের সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দেওয়ার জন্য যিনি সোনার পৈতে পরতেন৷ ঠাকুরবাড়ির প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের সঙ্গে যাঁর রেষারেষি নিয়ে চিৎপুরের রাস্তায় ছড়িয়ে অজস্র গল্পকথা৷ শিবকৃষ্ণ দাঁ ছিলেন বেঁটে, মোটা, কালো, রীতিমত কুৎসিতদর্শন৷ সেই কারণেই বোধহয় খুব গয়না পরতে ভালবাসতেন৷ গলায় মোটা সোনার চেন, হাতে সোনার তাগা, আঙুলে আংটি আর অবশ্যই ব্রাক্ষ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভিজ্ঞান সেই সোনার পৈতে৷ ধর্মপ্রাণ শিবকৃষ্ণ বাড়ির দূর্গা প্রতিমাকেও অজস্র গয়না গড়িয়ে দিয়েছেন৷ তার মধ্যে সোনার গয়না তো ছিলই, বিলেত থেকে দামী হীরে-জহরতের গয়নাও গড়িয়ে এনে দিয়েছেন মা-কে৷

শোনা যায়, একবার দশমীর দিন শিবকৃষ্ণ দাঁয়ের বাড়ির ঠাকুর বিসজর্নের জন্য রাস্তায় বেরিয়েছে৷ পিছনেই দ্বারকানাথ ঠাকুরের দূর্গা প্রতিমা৷ সেসময় খুব আকচাআকচি ছিল, কাদের ঠাকুর আগে গঙ্গায় যাবে, সেই নিয়ে৷ তা দ্বারকানাথের মেজাজ একটু খারাপ কারণ দাঁ বাড়ির ঠাকুর তাঁদের আগে বেরিয়ে গেছে৷ অগত্যা পিছন পিছনই যাচ্ছেন৷ হঠাৎ দ্বারকানাথের চোখে পড়ল, ভাসানের নৌকায় তোলার আগে শিবকৃষ্ণ দাঁয়ের ঠাকুরের গা থেকে গয়নাগুলো খুলে নেওয়া হচ্ছে৷ টেক্কা দেওয়ার, পিছন পিছন ঠাকুর নিয়ে যাওয়ার অপমান-এর শোধ তোলার একটা দারুণ মওকা পেয়ে গেলেন দ্বারকানাথ৷ সবাইকে হতবাক করে নির্দেশ দিলেন, তাঁর ঠাকুর গয়না সমেতই ভাসান হবে! সেবছর লক্ষাধিক টাকা খরচ করে প্যারিস থেকে জড়োয়ার গয়না আনিয়েছিলেন দ্বারকানাথ৷ সেই টাকা জলে যাবে বাবুয়ানা দেখাতে গিয়ে, এমনকী মোসাহেবরাও হাতেপায়ে ধরেছিল৷ কিন্তু প্রিন্স দ্বারকানাথ অনড়৷ শেষপর্যন্ত সেই একলাখি গয়না অঙ্গে নিয়েই সেবার জলে গেলেন ঠাকুরবাড়ির দূর্গা! দ্বারকানাথের লাঠিয়ালরা ঠাকুর জলে পড়ার পর জায়গাটা ঘিরে রাখল, যতক্ষণ না প্রতিমা পুরো ডুবে যাচ্ছে৷

হতে পারে এসব নিছকই গল্পকথা৷ বাবু কলকাতার আরবান লেজেন্ড৷ আবার হতেও পারে সত্যি৷ যেমন শিবকৃষ্ণ দাঁয়ের ঠাকুর সোনায় মুড়ে দেওয়ার কাহিনি কিন্তু গালগল্প নয়৷ বলছেন শিবকৃষ্ণ দাঁয়ের উত্তরসূরিরা৷ যদিও সেই গয়নার কিছুই আজ আর নেই৷ থাকার মধ্যে একমাত্র চালচিত্রের ওপরের অর্ধগোলাকৃতি অংশটা, যেটা রুপো জাতীয় কিছু দিয়ে তৈরি৷ ঠিক কী সঙ্কর ধাতু সেটা ওঁরা জানেন না৷ শিবকৃষ্ণ দাঁ আনিয়েছিলেন জার্মানি থেকে৷ মেড ইন জার্মানিলেখাটা এখনও পড়া যায়৷এত বছর পরেও কিন্তু তার ঔজ্জ্বল্য এতটুকু কমেনি৷ এবং এখনও এত ধারাল যে সে দিয়ে দাড়ি কামানো যায়, বলছিলেন অমরচন্দ্র দাঁ৷ আর রয়েছে সোনা-রুপোর জরির কাজ করা, লম্বা রুপোর হাতলওয়ালা মখমলের একখানি ছাতা, যা মাথায় দিয়ে এখনও সপ্তমীর সকালে গঙ্গাস্নানে যান দাঁ বাড়ির কলাবৌ৷ কিন্তু অত গয়না তাহলে কোথায় গেল৷ সে প্রশ্নের উত্তর রয়েছে দাঁ বংশের ইতিহাসেই৷

শিবকৃষ্ণ দাঁ ছিলেন গোকুলচন্দ্র দাঁ-র দত্তক পুত্র৷ লোহা এবং অভ্রের পাতের ব্যবসায়ী. বর্ধমানের সাতগাছিয়া গ্রামের গোকুল দাঁ-র প্রচুর অর্থ থাকলেও কোনও সন্তান ছিল না৷ ব্যবসা কে দেখবে, সেই দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে ১৮৪০ সালে গোকুলচন্দ্র সাতগাছিয়া ছেড়ে কলকাতা চলে আসেন৷ জোড়াসাঁকো অঞ্চলে প্রচুর জমিজমা কেনা ছিল তাঁর৷ সেখানেই বসতবাড়ি তৈরি হয় এবং নতুন বাড়িতে সেই বছর থেকেই পুজো শুরু হয়৷ আর সেই বছরই খুড়তুতো ভাই হলধর দত্ত-র ছোটছেলে শিবকৃষ্ণকে দত্তক নেন গোকুলচন্দ্র৷ শিবকৃষ্ণ-র বয়স তখন সবে চার৷ গোকুলচন্দ্র তাঁর উইলে নিয়ম বেঁধে দিয়েছিলেন যে প্রাপ্তবয়স্ক না হলে সম্পত্তিতে শিবকৃষ্ণের কোনও অধিকার বর্তাবে না৷ কিন্তু সম্ভবত বয়ঃপ্রাপ্তি হওয়ার আগেই ক্ষুরধার ব্যবসাবুদ্ধির পরিচয় দিয়েছিলেন শিবকৃষ্ণ দাঁ৷ বাঙালির প্রথম কোলিয়ারি আর অভ্র খনির মালিকানা তাঁরই ছিল৷ গোকুলচন্দ্রের লোহার ব্যবসা বাড়িয়ে তোলার পাশাপাশি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বরাত হাসিল করে এ অঞ্চলে প্রথম রেল লাইন পাতার কাজ, স্টেশন বানানোর কাজ তিনিই করেছিলেন৷ দাঁ পরিবারের দাবি, কলকাতায় বাঙালির ঘরে প্রথম টেলিফোন এসেছিল বাবু শিবকৃষ্ণ দাঁ-র বাড়িতেই৷ কিন্তু বেশিদিন বাঁচেননি শিবকৃষ্ণ৷ বস্তুত শিবকৃষ্ণ, তাঁর ছেলে পূর্ণচন্দ্র, এবং নাতি কীর্তিচন্দ্র, তিনজনেরই গড় আয়ু ছিল ৩০-৩৫ বছর৷ কিন্তু তিনজনের স্ত্রীই দীর্ঘজীবী হয়েছিলেন৷ নায়েব, মুনসেফ ইত্যাদিদের সহায়তায় ওই গিন্নিরাই যদিও সংসার চালিয়ে এসেছেন, কিন্তু প্রচুর ধনসম্পত্তি, তার মধ্যে মা দূর্গার ওই গয়নার অধিকাংশই, সম্ভবত তখনই বেহাত হয়ে যায়৷ এই তিন পুরুষের আমলে অবশ্য জোড়াসাঁকোর বসতবাড়িটি ক্রমশ আয়তনে বেড়েছে৷ গোকুলচন্দ্র তড়িঘড়ি বাড়ি বানিয়েছিলেন, যদিও দূর্গাপুজোর জন্য নাটমন্দির তাঁর সময়ই তৈরি হয়েছিল৷ থিয়েটারভক্ত কীর্তিচন্দ্র পরে গোটা দূর্গাদালান গড়ে তোলেন শেক্সপিয়রের আমলের বিদেশি নাট্যমঞ্চের অনুকরণে৷ তাঁর সময়ে চিৎপুরের যাত্রাপাড়ার অধিকাংশ পালার প্রথম অভিনয় হত দাঁ বাড়ির ওই ঠাকুরদালানেই৷ সেই দালান এখনও আছে, আছে মা দূর্গার চালচিত্রের মাথার বিলিতি কলকা, ওই সোনারূপোর কাজ করা মখমলের ছাতা আর অজস্র গল্পকথা৷ দূর্গাপুজো এখনও হয়, কিন্তু বিসর্জনের সময় ঠাকুর কাঁধে করে নিয়ে যাওয়ার জন্যে আর ওড়িয়া কুলিদের পাওয়া যায় না৷ ঠাকুর যায় লরিতে৷ জোড়া নৌকায় প্রতিমা নিয়ে গিয়ে, মাঝগঙ্গায় দু নৌকা দুদিকে সরিয়ে নিয়ে বিসর্জনের পুরনো রীতিও আর মানা যায় না৷ কারণ সেরকম নৌকাই আর কলকাতার ঘাটে ভেড়ে না৷ আগে ওইরকম বড় বড় নৌকায় নুন আসত কলকাতায়৷

জোড়াসাঁকোর আরেকটা দাঁ বাড়ির পুজোও বিখ্যাত৷ সেটা বন্দুকওলা দাঁ বাড়ি৷ ডালহৌসিতে যে এন সি দাঁ-এর বন্দুকের দোকান, সেই নরসিংহ চন্দ্র দাঁ পুজো শুরু করেছিলেন৷ ১৮৩৪ সালে বন্দুকের ব্যবসা শুরু, আর পুজোর শুরু ১৮৫৫/৫৬ সাল নাগাদ৷এই বাড়ির পুজোতে সন্ধিপুজোর সময় মা দূর্গার আবাহনে কামান দাগা হয়৷ কামান সত্যিই আছে৷ বিখ্যাত উইনচেস্টার কোম্পানির তৈরি ১০ বোরের একরত্তি একখানা কামান৷ সারা বছর রাখা থাকে ওঁদের বন্দুকের দোকানের তোষাখানায়, পুজোর সময় বাড়িতে নিয়ে আসা হয়৷ এগুলোকে বলা হয় স্যালুট ক্যানন৷ বলছিলেন কুমারকৃষ্ণ দাঁ, এন সি দাঁ-র চতুর্থ পুরুষ৷ অভিবাদন বা অভ্যর্থনা জানানোর জন্য একসময় বহুল ব্যবহৃত এই ক্ষুদে কামানের কার্তুজ আসত বিদেশ থেকে৷ এখনও এই বিশেষ ধরণের ফাঁকা কার্তুজ একমাত্র বিদেশেই তৈরি হয়৷ কিন্তু সরকারি নিয়মে এখন বিদেশ থেকে বন্দুক গোলাবারুদ, সবই আমদানি বন্ধ৷ ফলে যতদিন মজুত আছে বিদেশি কার্তুজ. ততদিন দাঁ বাড়ির সন্ধিপুজোয় তোপ দাগা চলবে৷তারপর কাজ চালাতে হবে বন্দুক দিয়ে৷

কেন সন্ধিপুজোর সময় এই কামান দাগা চালু হয়েছিল? একটা সম্ভাব্য কারণ হতে পারে যে শোভাবাজারে রাজা নবকৃষ্ণ দেবের বাড়িতে সন্ধিপুজোর সময় তোপ দাগা হত৷ তারই পাল্টা এই বিলিতি কামান৷ তাঁদেরও যে সমাজে কিছু অর্থ, প্রতিপত্তি হয়েছে, হয়তো সেটা জানান দিতেই৷ যদিও এই ধারণাকে আমল দিলেন না কুমারকৃষ্ণবাবু৷ বললেন, জাহির করার প্রবণতা আমাদের কোনওদিনই ছিল না৷ চিরকাল এ বাড়ির লোকেরা সাধারণভাবেই থেকেছে৷ এই ধুতি আর লম্বা ঝুলের বাংলা শার্টই ছিল একমাত্র পোশাক৷ এখনও বাড়ির কর্তারা তাইই পরেন৷ কামান দাগা শুরু হয়, যেহেতু পারিবারিক ব্যবসা বন্দুকের, সেই হিসেবে একটা নিজস্বতা তৈরি করার জন্য৷ কাউকে টেক্কা দেওয়ার কোনও উদ্দেশ্য তার মধ্যে ছিল না
কিন্তু বলছেন তো কার্তুজ প্রায় ফুরিয়ে এসেছে? এর পর তো কামান দাগা বন্ধ করে দিতে হবে? তাহলে নিজস্বতার কী হবে?
সে আর কী করা যাবে! আগে যেমন বর্ষাকালে কেয়াফুলের রেণু সংগ্রহ করে রাখা হত৷ বাড়ির মেয়েরা সেই রেণু দিয়ে পুজোর ধূপ বানাত৷ এখন আর এত কেয়াফুল কোথায় পাওয়া যাবে! তাই ওটা বাদ দিতে হয়েছে৷ তবু যতটা পুরনো প্রথা ধরে রাখা যায়, তার চেষ্টা করা হয়৷ যেমন মায়ের স্নানের জন্য বৃষ্টির জল ধরে রাখা, সাত নদীর জল, সাত সমুদ্রের জল লাগে, সেইসব জোগাড় করা ...
কারা করে এত সব?
বাড়ির মেয়েরা, বউরা করে৷ গিন্নিরা তো তদারকির জন্য আছেনই৷ চাল বাছতে হয় প্রচুর৷ এক মন চালের ভোগ হয় আমাদের৷ তারপর ধান বাছতে হয়, তিল বাছতে হয়...
গিন্নিরা নাহয় বাড়ির মেয়েদের দিয়ে কাজ করিয়ে নেন৷ কিন্তু বউরা? তারাও হাত লাগায়?
প্রশ্নটায় গল্প খোঁজার ইঙ্গিত পেয়ে মুচকি হাসেন কুমারকৃষ্ণ৷ সবাই সবদিন হয়ত পারে না৷ তাছাড়া পুজোর কাজ তো যখন তখন করা যায় না৷ স্নান করে, শুদ্ধ কাপড়ে করতে হয়৷ কাজেই যে যখন সময় পায়, করে৷ সবাই করে
আর জেনারেশন নেক্সট? বাড়ির ছোটরা?
সবাই৷ বরং পুজোর কটা দিন বাড়ি ছেড়েই কেউ নড়তে চায় না৷ একদিকে বউরা, অন্যদিকে বাড়ির জামাইরাও ছুটি নিয়ে এসে পুজোর ডিউটি করে যায়৷ আর একেবারে ছোট যারা, তারা হয়তো বাইরে ঠাকুর দেখতে গেল, কী ফুচকা-আলুকাবলি খেতে গেল৷ সে তো আমরাও ছোটবেলায় করেছি
খুব ব্যস্ত থাকতে হয় নিশ্চয়ই, পুজোর দিনগুলোয়?
সে আর বলতে৷ ভোর চারটে থেকে সেই রাত বারোটা, একটা পর্যন্ত৷ আর সব কাজ তো একেবারে ঘড়ি ধরে করতে হয়৷ সময়ের একটু এদিক ওদিক হলে তো হবে না৷ পাঁজিতে ঠিক যেরকম লেখা আছে৷ আগে তো পুজোর কয়েকদিন আগে গিয়ে আমরা অবজার্ভেটরি থেকে ঘড়ি মিলিয়ে নিয়ে আসতাম
আর এখন?
এখন তো কোয়ার্টজ, ডিজিটাল, কত রকম সব হয়েছে৷ হাসেন কুমারকৃষ্ণ৷

জোড়াসাঁকোর বন্দুকওলা দাঁ বাড়ির একেবারে উল্টো ছবি কিন্তু শোভাবাজারে রাজা নবকৃষ্ণ দেবের বাড়ির ছোটতরফের পুজোয়৷ এই বাড়িতে পুজোর সব কাজ মাইনে করা ব্রাক্ষ্মণরা করেন৷ বাড়ির লোকেদের, বিশেষ করে মেয়েদের, পুজোয় অংশ নেওয়ার রীতি নেই৷ এমনকী শাঁখ বাজাবার জন্যেও মাইনে করা লোক থাকে৷ রানীমা বা রাজকুমারীরা শাঁখ বাজাবেন, তাই কখনও হয় নাকি! প্রদীপের সলতে পাকানোর মত ঘরোয়া কাজও ব্রাক্ষ্মণরাই করেন৷ ২০০৫ সালে এই দেব বাড়িতে বউ হয়ে এসেছেন যাদবপুরের সুস্মিতা৷ বলছিলেন, প্রথম প্রথম খুব অস্বস্তি হত৷ এত দিনের পুজো, এত বড় পুজো. কিন্তু ফল কাটতেও বাড়ির মেয়ে-বউদের কেউ ডাকে না৷ পুজোর অন্যান্য কাজে হাত লাগানোর তো প্রশ্নই নেই৷ মনে হত, আগেকার পর্দা প্রথা এখনও কেন বহাল রয়েছে! তবে এখন অভ্যেস হয়ে গেছে৷ অবশ্য এখন পুজোর সময় ঠাকুরদালানে বসার অনুমতিটা পাওয়া যায়৷ নিজেদের মধ্যে গল্পগাছা, একটু আধটু হইহই হয়৷ তার পর কয়েক বছর হল রাজ্য পর্যটন নিগমের বনেদি বাড়ির ঠাকুর দেখার প্যাকেজে দুপুরের খাওয়াটা শোভাবাজার রাজবাড়িতেই হয়৷ সেজন্য হালুইকর এনে নানারকম পদ রান্না হয়৷ বাড়ির লোকেরাও ওইখানেই খেয়ে নেন৷ ফলে পুজোর কদিন রান্নাবান্না প্রায় বন্ধ থাকে৷ সুস্মিতার কাছে সেটা একটা বেশ মজার ব্যাপার৷ যেমন রাজবাড়ির পুজোর যে মিষ্টিগুলো তৈরি হয়, সেটাও সুস্মিতার বেশ উৎসাহের বিষয়৷ শ্বশুরবাড়ির পুজোর কথা বলতে গিয়ে অন্তত পাঁচবার বললেন বিশাল আকারের মন্ডা আর জিলিপির কথা৷ পাঁচ-ছটা লাড্ডু একসঙ্গে জুড়লে যত বড় হয়, সেই মাপের মন্ডা আর প্লেটের সাইজের এক একটা জিলিপি৷ একটা খেয়ে নিলেই অনেকক্ষণ ক্ষিদে পায় না৷ এই মন্ডা মেঠাই যাঁরা বানান, তাঁরা বংশপরম্পরায় রাজবাড়ির পুজোয় ভিয়েন বসিয়ে আসছেন৷ যেমন এখন যিনি এ বাড়ির ঠাকুর গড়েন, তিনি, তাঁর বাবা, তাঁর ঠাকুর্দা, পুরুষানুক্রমিকভাবেই এ বাড়ির প্রতিমা বানান৷ এখনও পুজোর সময় ফটকের পাশে যে নহবৎ বসে. বিসর্জনের সময় যে ভারিদের কাঁধে চেপে ঠাকুর গঙ্গায় যান, সবাই বছরের পর বছর ধরে অপরিবর্তিত৷ ঠিক যেমন এ বাড়ির পর্দা প্রথা!

কিন্তু কেন? এ প্রশ্নের উত্তর রয়েছে সম্ভবত রাজা নবকৃষ্ণ দেবের দূর্গাপুজোর ইতিহাসেই৷ বললেন তীর্থঙ্কর দেব, রাজা নবকৃষ্ণ দেবের অষ্টম পুরুষ৷ আরবি-ফার্সিতে সুপণ্ডিত নবকৃষ্ণ ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংসের ফার্সি শিক্ষক৷ প্রায় সমবয়সী হওয়ায় হেস্টিংসের সঙ্গে তাঁর এক ধরণের বন্ধুত্বও ছিল৷ শোনা যায়, নবাব সিরাজ উদ দৌল্লাকে মসনদচ্যুত করার যে চক্রান্ত হয়েছিল, তাতে মিরজাফররা মুর্শিদাবাদ থেকে ফার্সিতে লেখা যে চিঠি পাঠাতেন কলকাতায়, তার পাঠোদ্ধার করে দিতেন নবকৃষ্ণ৷ এই সহায়তার প্রতিদান হিসেবেই, পলাশীর যুদ্ধ জেতার পর শোভাবাজার অঞ্চলে নবকৃষ্ণকে বিপুল জমিজমা দান করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি৷ রাজা খেতাবও তাঁকে তখনই দেওয়া হয়৷ তড়িঘড়ি সেই জমিতে দালানকোঠা তুলে ফেলেন রাজা নবকৃষ্ণ দেব৷ পুরো রাজবাড়ি তখনই তৈরি না হলেও দূর্গাপুজোর জন্য ঠাকুরদালান তৈরি হয়ে গিয়েছিল৷ ১৭৫৬ সালের জুন মাসে পলাশীর যুদ্ধ শেষ হয়৷ তার তিন মাসের মধ্যেই শোভাবাজারে বাড়ি বানিয়ে ফেলছেন নবকৃষ্ণ৷ এবং সেই বাড়িতে ১৭৫৬ সালের সেই প্রথম দূর্গাপুজো ছিল কার্যত পলাশীর যুদ্ধের বিজয় উৎসব৷

এবার, কী হয়েছিল সেই উৎসবে? তীর্থংকর দেব পারিবারিক নথিপত্র ঘেঁটে যা জেনেছেন, সে আমলের পদস্থ সাহেবসুবোরা সবাই আমন্ত্রিত ছিলেন সেই পুজোয়৷ তাঁদের আপ্যায়নের জন্য ঢালাও মদ ও মাংসের আয়োজন রাখা হয়েছিল৷ মাংস বলতে খাসি, গরু, শুয়োর, যা যা মাংস সাহেবরা খান, সিদ্ধ-নিষিদ্ধ, সব গোত্রের মাংস৷ সেই সঙ্গে বিদেশি মদের ফোয়ারা ছুটেছিল৷ লখনৌ থেকে বাইজি আর গাইয়ে-বাজিয়ে আনা হয়েছিল৷ এসেছিলেন সেকালের একমাত্র শ্বেতাঙ্গ বাইজি, বিখ্যাত নিকি’! এছাড়া ঠাকুরদালানের সামনের মাঠে খেলা দেখাতে এসেছিল মাদারির দল, বাজিকরেরা৷ লাঠিখেলা, তলোয়ার খেলা থেকে অশ্লীল ভাঁড়ামো, অতিথিদের মনোরঞ্জনের জন্য সবই হয়েছিল৷ স্বাভাবিকভাবেই এই সমারোহে বাড়ির মহিলাদের থাকার কোনও উপায় ছিল না৷ সমসাময়িক লেখালেখি থেকে জানা যায়, শোভাবাজার রাজবাড়ির দূর্গাপুজোর চরিত্র দীর্ঘ সময় ধরে এই রকমই ছিল৷ প্রধান অতিথি হতেন সাহেব-মেমসাহেবরা এবং তাঁদের খাতিরে তথাকথিত ম্লেচ্ছ সংস্কৃতির জোয়ার বয়ে যেত বারবাড়িতে৷ কাজেই পুজোর সময় রাজবাড়ির অন্তঃপুরবাসিনীদের অন্দরমহলে থাকাটাই রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যে পর্দা প্রথাটা এখন কার্যত বাঁধা নিয়ম হয়ে গেছে৷

আরও একটা ব্যাপার হয়েছিল, বলছেন তীর্থঙ্কর দেব, যে রাজা নবকৃষ্ণ প্রথমবারের ওই দূর্গাপুজোর পরই বেশ কিছু শত্রু বানিয়ে ফেলেছিলেন৷ একে তো কোম্পানির অনুগ্রহে নব মুন্সি থেকে রাজা নবকৃষ্ণ হয়েছেন, তাতে সে আমলের আগমার্কা অভিজাতদের আঁতে লেগেছে৷ তার ওপর ব্রিটিশদের সঙ্গে দহরম মহরম ক্ষেপিয়ে দিয়েছে মহারাজা নন্দকুমারের মত স্বাভিমানীদের৷ আর পুজোর ওই বোলবোলাও থেকেও শুরু হয়ে গেছে রেষারেষি৷ রাজা নবকৃষ্ণের মূল টক্করটা ছিল কৃষ্ণনগরের স্বনামধন্য রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে৷ কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির দূর্গাপ্রতিমার সাজ যিনি বানাতেন, তাঁকেই বেশি টাকা দিয়ে কলকাতায় ধরে নিয়ে আসেন নবকৃষ্ণ৷ সেই প্রথম কৃষ্ণনগরের সাজ এল কলকাতায়৷ অবশ্য শুধু দূর্গাপুজো নয়, সব ব্যাপারেই ছিল টেক্কা দেওয়ার চেষ্টা৷ রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের মত নবকৃষ্ণও তখনকার বিদ্বান, দিগগজ পণ্ডিতদের নিয়ে নিজের নবরত্ন সভা বানালেন৷ বঙ্গদেশের সেরা পুরোহিত ছিলেন যিনি, সেই জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন হলেন রাজবাড়ির কুল পুরোহিত৷ এবার নবকৃষ্ণ নিজে কায়স্থ কুলপতি হলেও ব্রাক্ষ্মণ তো ছিলেন না! ফলে ওই ব্রাক্ষ্মণ শিরোমনিরা যে বিধান দিয়েছিলেন, তাই মেনেই পুজোর যাবতীয় দায়িত্ব মাইনে করা ব্রাক্ষ্মণদের হাতেই ছেড়ে দিয়েছিলেন ধর্মভিরু, সামাজিক অনুশাসনে বিশ্বাসী নবকৃষ্ণ৷ সেই প্রথাই আজও চলে আসছে৷

পুরনো কলকাতায় একটা কথা চালু ছিল যে, মা দূর্গা এসে গয়না পরেন শিবকৃষ্ণ দাঁয়ের বাড়িতে, নাচ দেখেন শোভাবাজারের রাজবাড়িতে আর ভোগ খান ... না, যে বাড়ির নাম বলা হত, সেই বাড়ির কথা এই লেখাতে বলব না৷ কারণ নানাবিধ কারণে কলকাতার অনেক বনেদি বাড়ির পুজোই এখন কতকটা নিয়মরক্ষের পুজো হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ বরং একটা বাড়ির কথা বলা যাক, যে বাড়ির পুজোর আয়োজন এবং আন্তরিকতা দেখে মনে হয়, মা দূর্গা কলকাতা শহরের যেখানেই যান, এ বাড়িতে নিশ্চয়ই একবার রাঙা চরণ দুখানি রাখতে আসেন৷ দর্জিপাড়ার মিত্রবাড়ি৷ ১৮০৬ সালে এই বাড়িতে পুজো শুরু করেন রাধাকৃষ্ণ মিত্র৷ সম্পর্কে ইনি বিখ্যাত সাতুবাবু-লাটুবাবুদের বাড়ির প্রথম পুরুষ যিনি, সেই রামদুলাল সরকারের জামাতা৷ মিত্রবাড়ির পুজোর বড় বৈশিষ্ট্য হল এর পারিবারিক আবহ৷ পড়শি শোভাবাজারের সুস্মিতা শুনলে হয়ত একটু আধটু হিংসেও করতে পারেন যে দর্জিপাড়ার মিত্রবাড়ির দূর্গাপুজোর সব কাজ বাড়ির মেয়েরাই করেন! কেন, মেয়েরা কেন? প্রশ্নটা শুনে মিত্রবাড়ির মেয়ে অনসূয়া বিশ্বাস, বাড়ির ছেলেদের যেভাবে হয়তো বকুনি দেন ঠিক সেভাবেই বললেন, কেন আবার! বাড়ির কোনও কাজে ছেলেদের পাওয়া যায় নাকি!’ তার পরেই গিন্নিসুলভ জেরা, পারবে ছেলেরা, ১০৮ বেলপাতা নিখুঁত করে বাছতে? একটা পাতাও কাটা-ছেঁড়া থাকলে চলবে না! পারবে দুব্বো বাছতে? একটারও শিস কাটা থাকলে পুজোয় দেওয়া যাবে না! তার পর তুলসি পাতা বাছা, লাল ফুল সাদা ফুল আলাদা করে রাখা .. আছে ছেলেদের অত ধৈর্য!’

কথা বলতে বলতে একটু পরে অবশ্য অনসূয়াদেবী নিজেই বললেন অন্য কারণটা৷ রাধাকৃষ্ণ মিত্র-র পর তাঁর মেজো ছেলে রাজকৃষ্ণ মিত্র পুজোর ভার নেন৷ এখানে ভার বলতে পুজোর আর্থিক দায়দায়িত্ব, যেটা পুরুষানুক্রমিকভাবে থেকেছে নির্দিষ্ট কোনও একজনের হাতে৷ ফলে মিত্রবাড়ির পুজো কখনও শরিকি পুজো হয়নি, কিন্তু সব শরিকরাই পুজোয় অংশ নিয়েছেন৷ এভাবেই রাজকৃষ্ণের পর তাঁর ছেলে অমরেন্দ্রকৃষ্ণ, তার পর তাঁর ছেলে মানবেন্দ্রকৃষ্ণের হাতে আসে পুজোর দায়িত্ব৷ এখনও তাঁর উত্তরসূরিরাই পুজো চালিয়ে যাচ্ছেন৷ কিন্তু মানবেন্দ্রকৃষ্ণের তিন ছেলের কারও পুত্রসন্তান ছিল না৷ ফলে পুজোর দায়িত্ব কিছুটা বাধ্য হয়েই নিতে হয়েছিল পরিবারের কন্যাসন্তানদের৷ মিত্রবাড়িতে এখনও সেই মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থাই বহাল! দশকর্মার বাজার থেকে পুজোর জোগাড়, সব কাজের ভার নিয়েছেন বাড়ির মেয়ে-বউরা৷ আরও একটা কাজ ওঁরা খুব ভালবেসে, যত্ন নিয়ে করেন৷ সেটা নৈবেদ্য সাজানো৷ চাল-কলা থেকে পান-সুপুরি, ঠাকুরের সামনে ওঁরা যাইই সাজিয়ে দেন, তার মধ্যে একটা শৈল্পিক ছোঁয়া থাকে৷

মিত্রবাড়ির আরও একটা চমৎকার পরম্পরা, সারা বছর ধরেই ওঁদের নৈবেদ্যর প্রস্তুতি চলে৷ মা-কে আপ্যায়নের? নাকি পরিবারের সবথেকে আদরের মেয়েটি সম্বৎসরে একবার বাপের বাড়ি আসবে বলে মা যেমন তার পছন্দের জিনিসগুলো বানিয়ে রাখেন, এটা তেমনই? বলা ভারি শক্ত৷ কিন্তু কুলের সময় কুল, আমের সময় আম জারিয়ে ওঁরা আচার বানান৷ আগুনের আঁচে রান্না করার বিধান নেই, তাই রোদে দিয়ে পাক করা হয়৷ এভাবেই নতুন ডাল উঠলে তার বড়ি বানিয়ে রাখা, যখন পালং শাক ওঠে তখন বড়ির জন্য ডাল বাটার সময় একটু শাক কুচিয়ে মিশিয়ে দেওয়া, বছরভর এমন আয়োজন চলতেই থাকে৷ আর পুজো এসে গেলে তো কাজের আর শেষ নেই৷ প্রতিমা সাজানোর কাজটা যেমন বাড়ির লোকেরাই করেন৷ প্রতিমার কাপড় আঁকা থেকে ঠাকুরের সাজ বানানো, সব নিজেদের হাতে৷ বাড়ির ছোটরাও হাত লাগায়৷ কেউ রং করা শনের গুছি পাকিয়ে কার্তিকের চুল বানাল তো কেউ অসুরের গোঁফ৷ ছোটরা কাজ না পেলে বরং বেশি দুঃখ পায়, বলছিলেন ওঁরা৷

কথা বলতে যখন মিত্রবাড়ি গিয়েছিলাম, সেই সকালে ওই ছোটদেরই দুজন, একজন ক্লাস সেভেন, অন্যজন আরও ছোট,  অনসূয়াদেবীর ভাইপোর দুই যমজ ছেলে ইস্কুলে যাচ্ছিল৷ খবরের কাগজ থেকে কেউ একজন ওদের বাড়ির পুজো নিয়ে কথা বলতে এসেছে শুনে তারা অনসূয়াদেবীকে, ওদের টুমা-কে বলে গেছে, এখন তুমি কথা বলছ, এর পর তো বড় হয়ে আমাদেরই বলতে হবে, বলো?


বাড়ির পুজোর ধারাটা বোধহয় এভাবেই অন্তঃসলিলা ফল্গু ধারার মত তিরতিরিয়ে বইতে থাকে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে৷ ঠাকুর ভাসান চলে যাওয়ার পর অন্ধকার পুজোমণ্ডপে জ্বলতে থাকে একলা প্রদীপ হয়ে৷ এই, বড় হয়ে আমরাও করব, এই বোধটা৷

No comments: