আম আঁটির ভেঁপু৷ বালক বয়সের সেই বিস্ময়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে
দিয়েছিল, না, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় নন৷ পাঁচু৷ আমাদের কাজের মাসির ছেলে৷
ছোটবেলার বন্ধু, চিন্তক এবং পথ প্রদর্শক৷ গোয়াবাগান বস্তির বাসিন্দা পাঁচুই
শিখিয়েছিল, শহুরে বাংলায় পাঁচ নয়া, দশ নয়া নয়, তাদের অব্যর্থ স্ট্রিটস্মার্ট উচ্চারণ
হচ্ছে পাঁই নয়া এবং দয় নয়া৷ খরখরে পাথরে শুকনো আমের আঁটির দু ধার ঘষে কত সহজে
বাঁশি বানিয়ে ফেলা যায়, সেটাও পাঁচুরই শেখানো৷ তার তীক্ষ্ণ, কান ফুটো করা পিঁ পিঁ
আওয়াজের কাছে কোথায় লাগে ভুভুজেলা-র বিনবিনানি৷ অবশ্য শিখিয়েছিল বলা ভুল৷ শিক্ষায়
কোনও খুঁত না থাকলেও আধার মোটেই ভাল ছিল না৷ ফলে ডাংগুলি খেলা, গুলি খেলার মত আম
আঁটির ভেঁপু বানানোটাও শেখা হয়ে ওঠেনি৷ তাতে অবশ্য পাঁচুর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আরও
বেড়ে গিয়েছিল৷ এবং গ্রীষ্মের বহু দুপুর নষ্ট হয়েছিল ছাদের পাঁচিলে আমের আঁটি ঘষে
ভেঁপু বানানোর ব্যর্থ চেষ্টায়৷ পরে, গ্রামের মেঠো পথে রাখাল ছেলেদের মুখে আম আঁটির
ভেঁপুর আওয়াজ শুনে রীতিমত ঈর্ষা হত৷ যদিও তখন জুটে গেছে স্কেল চেঞ্জিং মাউথ অরগান৷
হারমনিকা৷ মেড ইন জার্মানি৷ কিন্তু আম আঁটির ভেঁপু মানে তখনও মন হু হু করা দুঃখবোধ৷
যেটা আয়ত্ব করা হয়নি৷ পারিনি৷
কিন্তু না পারার কী আর শেষ আছে৷ আমেরও আগে আসে আমের মুকুল৷
জানুয়ারির শেষে, ফেব্রুয়ারির শুরুতে৷ যখন সরস্বতী পুজো৷ যে দিন, সারা বছর স্কুল
ড্রেসে দেখা পাড়ার মেয়েদের বাসন্তী রং শাড়ি৷ কিন্তু তারা পাত্তা দিত না মোটেই৷
মনের দুঃখে মা সরস্বতী-কেই বলতাম, উফ, আরেকটু ফর্সা করতে পারলে না মা৷ নিদেনপক্ষে
একটা মোটর বাইক৷ তবু দুর্মর আশা নিয়ে মেয়েদের ইস্কুলে ইস্কুলে৷ ওই একটা দিনই ঠাকুর
দেখার অছিলায় ঢোকা যেত যে৷ কোনও অসভ্যতা করতাম না যদিও৷ মানে যেরকম অসভ্যতা করলে
দারোয়ান দিয়ে বের করে দেয়, সেরকম কক্ষনো না৷ আমের মুকুল সাক্ষী৷ খালি তার মধ্যেই
আড়চোখে দেখে নেওয়া, তাকালো কি৷ আধখানি কৃপাদৃষ্টি৷ আলতো হাসি৷ অথবা কপাল খুব ভালো
হলে একেবারে শুভদৃষ্টি৷
তবে সরস্বতী পুজো
মানে বারোয়ারি পুজোর জোগাড়েও হাতেখড়ি৷ গঙ্গার জলের অভাবে পাড়ার টিউবওয়েলের
সামান্য ঘোলা জলেই যে দিব্যি কাজ চালিয়ে নেওয়া যায়, সেই প্রথম শেখা৷ রাস্তা থেকে
ধরে আনা প্রায় বৃদ্ধ পুরুত মশাই তো ধরতে পারেনই না, এমনকী মা সরস্বতীও পাপ নেন না৷
তখনই শেখা, আমপাতা জোড়া জোড়া, মারবো
চাবুক ছুটবে ঘোড়া-র বাইরেও আম্রপল্লবের কী অপার মহিমা৷ পুজোর ঘটে দেওয়ার জন্যে আম
পাতা লাগে, শোলার কদম ফুলের সঙ্গে সার দিয়ে দড়িতে বেঁধে দরজায় টাঙাতেও আমপাতা
মাস্ট৷ এবং সেখানে জাম পাতা বা কাঁঠাল পাতার ভেজাল দেওয়া একেবারেই চলে না৷ ভাবা
যায়৷ গঙ্গা জলে গোঁজামিল, কিন্তু আম পাতায় নয়৷
আসলে পুজোর আবশ্যিক উপকরণের মধ্যে, পঞ্চ শস্য, পঞ্চ গব্য
ইত্যাদির মত যে পঞ্চ পল্লব, আম পাতা তার অন্যতম৷ তুলসি বা বেল পাতার মতই তার
মাহাত্ম্য৷ এ ব্যাপারে পুরোহিতদের ইনপুট হল, লক্ষ্মী এবং গোবর্ধনের অধিষ্ঠান ঘটে
আম গাছে৷ কাজেই ধন-সম্পদ, শ্রীবৃদ্ধির সঙ্গে আম পাতার যোগ আছে৷ গন্ধর্বদেরও নাকি
আম গাছ অত্যন্ত প্রিয়৷ এবং শ্রীযুক্ত মদনদেবের৷ যে জন্য আমের সঙ্গে সন্তান উৎপাদন
এবং বংশবৃদ্ধির একটা সম্পর্ক আছে৷ আরও আগে, যখন পাথর, গাছ ভক্তিভরে পূজিত হত, তখনও
আম গাছ নাকি ফার্টিলিটি কাল্ট-এর সঙ্গে যুক্ত ছিল৷ হতেই পারে, বছর বছর নিয়ম করে, বিয়োয়
যে গাছ, পাখ পাখালির ঠোঁট থেকে খসে পড়া আঁটি মাটিতে পড়ার পর, সামান্য জল পেলেই
তরতরিয়ে গজিয়ে যায় যে গাছের চারা, তার সঙ্গে প্রজনন সংস্কৃতির সম্পর্ক গড়ে ওঠাই
স্বাভাবিক৷ কাজেই সবমিলিয়ে আম এবং আম গাছ, যাকে বলে বেশ একটা মাঙ্গলিক প্যাকেজ৷
পুজো আচ্চায়, শুভ অনুষ্ঠানে যার কোনও উন্নততর বিকল্প নেই, পরিবর্তন তো নয়ই৷
অবশ্য এই আম মাহাত্ম্য সম্পর্কে এত বোধোদয় হওয়ার সুযোগ ওই সরস্বতী
পুজোর বয়সে ছিল না৷ বরং ব্যাপারটা কিছুটা বাড়ির বড়কত্তার নির্দেশের মত ছিল৷ মুখে
মুখে তক্কো কোরো না, যা বলছি করো৷ তবে আমের বাজারদর সম্পর্কে সম্যক ধারণাও হয়ে
গিয়েছিল ওই কিশোর বয়সেই৷ না, চল্লিশ টাকা কিলোর অমৃতস্বাদ ল্যাংড়া বা কুড়ি টাকা
কিলোর পানসে বোম্বাই আমের দর নয়৷ এক ছালা কাঁচামিঠে আমের দর৷ একটা মোটা কাপড়ের
সাদা সুতির হাফহাতা জামা৷ তাও পুরনো৷ ওরকম একটা জামা দিলেই পাওয়া যেত বড় বড় চটের
থলের দু থলে ভর্তি কাঁচামিঠে আম৷ পুরনো স্কুল ইউনিফর্মের জামাগুলোর সদগতি হত
ওভাবেই৷ প্রবল প্রতাপ বাহাদুরদা এবং বাকি দারোয়ানদের নজর এড়িয়ে দিনেদুপুরে আমবাগান
লুঠ করত ছেলেগুলো৷ সবই আশপাশের গ্রামের৷ শাকিল বা সরিফুল, এমন সব নাম ছিল তাদের৷
সকালে একখানা পুরনো জামা দিলেই দুপুরে এক বস্তা কাঁচা আমের হোম ডেলিভারি৷ সে আম
খেয়ে শেষ হত না৷ শেষে এক সহপাঠীর প্ররোচনায় শুরু হল আমের আচার বানানোর উদ্যোগ৷
কিন্তু যে জিনিস, গরমের ছুটির দুপুরে ছাদে রাখা বয়াম থেকে চুরি করে খাওয়া এত সহজ,
সেটা বানানো এত শক্ত কে জানত৷ হস্টেলের রান্নাঘর থেকে রাঁধুনেদের হাতে পায় ধরে সর্ষের
তেল, সর্ষে গুঁড়ো, নুন, চিনি, ইত্যাদি যা যা ভেবে বার করা সম্ভব, সবই জোগাড় হল৷
একেবারে কচি বাচ্চাদের তেল মাখানোর কায়দায় একেকটি কাঁচা আমের ফালিকে ধরে, যত্ন করে
তেল-নুন মাখিয়ে শোয়ানো হল খবরের কাগজের বিছানায়৷ হস্টেলের ছাদে, যে জায়গায় কখনও
রোদ সরে না, সেখানে তাদের বেছানো হল৷ এবং প্রতিদিন নিয়ম করে, দুপুরে হস্টেলে খেতে
আসার সময় ছাদে গিয়ে তাদের উল্টে পাল্টে দেওয়া হত৷ এই অত্যধিক যত্নের কারণেই কিনা
কে জানে, জষ্টি মাসের কড়া রোদ সত্ত্বেও তারা কেউ শুকিয়ে আমসি হল না৷ বরং কেমন
একটা ভ্যাদভেদে হয়ে, তাদের গায়ে ছাতা ধরে গেল৷ বিশেষজ্ঞের মতামত নেওয়ার জন্য ধরে
আনা হল ওই শাকিল, শরিফুলদের কাউকে৷ সে এসে, দেখে, একগাল হেসে রায় দিল, সব পচে নষ্ট
হয়ে গেছে৷ আচারপর্বের সেখানেই ইতি৷
তবে আচার ছাড়াও কাঁচা আমের আরেকটি দেবভোগ্য সংস্করন হত সে
আমলে, সেটা হল আমপোড়ার শরবৎ৷ আজকের সিন্থেটিক আম পানা-র যুগে তার দিব্য স্বাদ
বোঝানো শক্ত৷ তখনও রান্নার গ্যাস এত জনপ্রিয় হয়নি, মাইক্রোওয়েভ আভেন তো জেমস
বন্ডের সিনেমাতেও দেখা যায় না৷ বাড়ি বাড়ি রান্না হত মাটির উনুনে৷ সেই উনুনের আঁচ
মরে এলে, গরম ছাইয়ের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হত কাঁচা আম৷ ছাই ঠাণ্ডা হওয়ার আগেই সবুজ
খোসা পুড়ে কালো, কাঁচা আমের শক্ত শাঁস গলে নরম৷ বিটনুন, চিনি, ভাজা জিরে গুঁড়ো
দিয়ে সেই আম চটকে, পাতলা কাপড়ে সেই মিশ্রনকে ছেঁকে, জলে মিশিয়ে তৈরি হত শরবৎ৷ এমন
সুস্বাদু, স্ফূর্তিবর্ধক পানীয় ভূভারতে আছে কিনা সন্দেহ৷ তার কাছে কোথায় লাগে
উত্তর ভারতের ম্যাঙ্গো লস্যি৷ কলেজ স্কোয়্যারের পুব কোণের শরবতের দোকান
প্যারামাউন্টের ডাবের শরবৎ তাও কিছুটা কাছাকাছি আসতে পারে৷
আসলে ভাল আম অনেকটা কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনামের মত৷ নেহাৎ
পরম ভক্ত না হলে দশ বারোটার বেশি নাম খেয়াল থাকে না৷ প্রায় প্রতি গ্রীষ্মে, সেই
মুর্শিদাবাদ থেকে থলে বোঝাই আম নিয়ে বাড়িতে দিয়ে যেতেন আতাউর রহমান৷ কোনও কারণ
নেই, স্রেফ পাতানো ভাগ্নে-ভাগ্নিকে ভাল আম খাওয়াবেন বলে৷ তাঁর সৌজন্যেই চাখার
সুযোগ হয়েছিল দুর্লভ কোহিতুর৷ যে আম একটু বড় হওয়ার পরই তুলোর জামা পরিয়ে দেওয়া
হয়, পাছে তাদের মহার্ঘ শরীরে দাগ লেগে যায়৷ পরখ করা গিয়েছিল বাদশাভোগ, রানীপসন্দ,
বেগমবাহার৷ কোন আম কীভাবে খাওয়া উচিত, তার অনেক টিপস দিয়ে যেতেন আতাউর রহমান৷ যেমন
কোন আম কাটার আগে একটু বরফ জলে ভিজিয়ে রাখলে স্বাদ আরও খুলে যায়, কোন আম ছুরি-বঁটি
দিয়ে কাটতে নেই, ঝিনুকের ছুরি দিয়ে কেবল খোসাটা ছাড়িয়ে নিতে হয়, কোন আম সেটুকুও
সহ্য করতে পারে না, তাদের জন্য কেবল বাঁশের কঞ্চি শানিয়ে বানানো ছুরি৷
সম্ভবত এই কারণেই আম বাকি ফলের থেকে আলাদা৷ আম খাওয়া একটা
আলাদা সংস্কৃতি৷ এক অন্যতর অনুশীলনের ব্যাপার৷ তাও বাংলায় আম ডাল বা আমের চাটনি
ছাড়া, রান্নায় আমের ব্যবহার তেমন নেই৷ আমচুর-কে যদি সে অর্থে আম না ধরা হয়৷
দক্ষিণ ভারতের কেরল এ ব্যাপারে বরং অনেক বেশি উদ্ভাবনশীল৷ আর আম দিয়ে রান্নার
একেবারে হদ্দ করে ছেড়েছে থাইল্যান্ড৷ মাছ মাংসের নানা বিচিত্র থাই পদ রয়েছে আমের
সঙ্গে যুগলবন্দিতে৷ তবে কি, রসিকদের চাহিদার শেষ নেই৷ ফজলি আম তাদের ভাল লাগে, তাও
তারা বলেন, আনো হে, ফজলিতর আম৷
No comments:
Post a Comment