লক্ষ্মীসোনা

চোখ খুলে দিয়েছিল ফেলুদা৷ সোনার ছেলে, সোনার বাংলা কি সোনা দিয়ে তৈরি? ভাগ্যিস! মিডাস রাজা যা ছুঁয়ে দিচ্ছিলেন, তাই সোনা হয়ে যাচ্ছিল৷ খাবার, জল, সঅব৷ পরশপাথর হাতে পরেশবাবুরও একই দশা হয়েছিল৷ সেখানে সোনার বাংলা হলে আর দেখতে হত না৷ বর্গিরা মোটেই বাংলা ছেড়ে নড়ত না৷ মারাঠারত্ন বালাসাহেব ঠাকরে স্বাধীন ভারতে এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হতেন৷ যাঁদের ৩৩ বছরে নাভিশ্বাস উঠছে, তাঁরা ৬৩ বছরের ঠেলাটা বুঝতেন৷ ২০১১ সালে পরিবর্তন অবশ্য নিশ্চিত ছিল৷ রাজ্যাভিষেক হত উদ্ধব ঠাকরের!

যত্তো বাজে কথা৷ হচ্ছিল সোনা নিয়ে৷ আমরা আদর করে সবকিছুকে সোনালি রাংতায় মুড়ে দিতে ভালবাসি৷ সোনা না হোক, সোনালি তো৷ এমনকি বাচ্চাকে আদরের সময়ও ছোন্তু সোনা, মান্তু সোনা বলে একেবারে লটরপটর হয়ে যাই৷ আসলে সোনা ব্যাপারটার মধ্যেই একটা আলাভোলা, নরমসরম ব্যাপার আছে৷ সোনা এই ধরিত্রীর সবথেকে নরম ধাতু৷ অনায়াসে তাকে পিটিয়ে পাত করে দেওয়া যায়, এমনই তার ধাতুদৌর্বল্য৷ এতটা পাতলা করে দেওয়া যায় সেই সোনার পাত-কে যে আলো যাওয়া আসা করতে পারে তার এপার ওপার৷ সেই আলোর রঙ নীল৷ সবুজ আভাযুক্ত নীল৷ কারণ সোনার পাত হলুদ আর লাল রঙ একদম সহ্য করতে পারে না৷ ফিরিয়ে দেয় এই দুই রঙের আলো৷ আর ফেরায় ইনফ্রারেড রশ্মিকে৷ যে কারণে তাপ নিরোধক পোশাকে, মহাকাশচারীদের চোখ ঢাকা চশমায় সোনা ব্যবহার করা হয়৷

কিন্তু ফোকাস নড়ে গেলে হবে না৷ মোদ্দা কথা হল সোনা দূর্বলচিত্ত৷ সম্ভবত সেই কারণেই মহিলাদের এত প্রিয়৷ মুকুট করে মাথায় রাখো, অথবা বিস্কুট বানিয়ে লকারে, হলদেটে দাঁত বার করে সে হেসেই যাবে৷ স্ত্রৈণ স্বামী বা বয়েসকালের প্রেমিকরাও এত বাধ্য, বশংবদ হয় না৷ সোনা নিয়ে মহিলাদের একমাত্র মেজাজ গরম হয় স্যাঁকরার কাছে পুরনো গয়না ভেঙে নতুন গয়না বানাতে গেলে৷ নিক্তি মেপে ওজন করার পর স্যাঁকরা প্রায় সুপ্রিম কোর্টের গলায় বলে, এর থেকে পান বাদ যাবে৷ পান, অর্থাৎ কিনা খাদ৷ যা না মেশালে সোনার শিরদাঁড়া শক্ত হয় না৷ আবার নতুন গয়না গড়ানোর সুপারি দেওয়ার সময়ও ফের পান যোগ হয়৷

অবশ্য নিখাদ সোনার গয়নাও পাওয়া যায়৷ পাক্কা ২৪ ক্যারেট৷ আপাতত সাড়ে ১৬ হাজার টাকা ভরি৷ তবু ফিবছর ধনতেরাসে, চন্দ্রে গ্রহণ লাগার মত, পাকা কাঁঠালে থিকথিকে মাছির মত সোনার দোকানে ভিড়৷ ছাপোষা গেরস্থ বাঙালিরও আজকাল ধনতেরাসে দেখি ভয়-তরাস সব উবে যায়৷ বানিজ্যিক হিসেব বলছে, বিশ্বে সবথেকে বেশি সোনা কেনা বেচা হয় .... না, ভুল ভাবলেন৷ দুবাইয়ে নয়৷ এই গরিব ভারতবর্ষে৷ ভারতীয়রাই সবথেকে বেশি সোনা কেনে৷ অলংকার হিসেবে তো বটেই, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সঞ্চয় হিসেবেও সোনা৷ মন্দা, মুদ্রাস্ফীতিতেও যার ঔজ্জ্বল্য হারায় না৷

দুঃসময়ের বন্ধু সোনার আরেকটা গুণও আছে৷ সোনা সচ্চরিত্র৷ হাওয়ায়, আর্দ্রতায়, জলে তার চরিত্র নষ্ট হয় না৷ এদের কারও সঙ্গে সোনা রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটায় না৷ বস্তুত সমস্ত ধাতুর মধ্যে সোনা সবথেকে কম কেমিক্যালি রিঅ্যাক্টিভ৷ ফলে তার ক্ষয়ও কম৷ সম্পদ হিসেবে সোনা তাই এত মহার্ঘ৷ যুগ যুগ ধরে৷ তাই সবচে প্রিয়, সবথেকে দামি জিনিসটার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া সোনার নাম৷ স্বর্ণযুগ, স্বর্ণকন্ঠ ... ৷ তাই সবথেকে ভালবাসার মানুষটা, লক্ষ্মীসোনা৷

বেথলেহেমে যখন সদ্যোজাত যীশুকে দেখতে গিয়েছিলেন প্রাচ্যের তিন জ্ঞানী মানুষ, তাঁদের একজনের হাতে উপহার হিসেবে ছিল সোনা৷ প্রতীকি উপহার৷ রাজা, আর উচ্চবর্গের, অভিজাত শ্রেণীর মানুষদের প্রতীক৷ রাজার রাজা-র জন্য যোগ্য উপহার৷ ইতিহাস বলে, খ্রিষ্টজন্মের চার হাজার বছর আগেও সোনার উল্লেখ পাওয়া যায়৷ আর প্রাচীন মিশরে নাকি আক্ষরিক অর্থেই ধুলোমুঠি করলে সোনামুঠি হত৷ হয়তো সেই সুবাদেই পিরামিডের গর্ভগৃহে সোনা বোঝাই থাকত৷ ৩৩০০ বছর সঙ্গোপনে থাকা তুতেনখামেনের সমাধিতে ঢুকে সোনার ছড়াছড়ি দেখে হাওয়ার্ড কার্টার-এর দলবলের চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গিয়েছিল৷ নেহাত কবর লুটেরারা তুতেনখামেনের রত্নভান্ডারের নাগাল পায়নি৷ নয়তো অধিকাংশ পিরামিড আর তাদের সমাধিগৃহ তছনছ হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই৷ স্রেফ সোনার লোভে৷

সোনা পাওয়া গেছে অ্যাজটেক পিরামিডেও৷ যে সোনার জন্যে মেক্সিকো উপত্যকার শান্তশিষ্ট অ্যাজটেকদের জিনা হারাম করে দিয়েছিল স্প্যানিশ ডাকাতরা৷ যদিও যতটা গল্প ছড়িয়েছিল, তত সোনা অ্যাজটেকদের ভান্ডারে ছিল না৷ ছিল টুমবাগা৷ সোনা, তামা আর প্ল্যাটিনামের এক শঙ্কর ধাতু, যে বিদ্যেটা ভালই রপ্ত করেছিল অ্যাজটেকরা৷ তাছাড়া সোনা জিনিসটা তারা খুব একটা পছন্দও করত না৷ প্রকৃতি-ভিরু অ্যাজটেকরা সোনা-কে মনে করত ঈশ্বরের বিষ্ঠা৷ বরং নানা রঙের পালক আর পোখরাজ ছিল তাদের অনেক বেশি প্রিয়৷

কিন্তু পালক আর পাথরে স্প্যানিশ লুটেরাদের কোনও আগ্রহ ছিল না৷ তারা বারে বারে হামলা চালিয়েছে, আর জাহাজ ভরে নিয়ে গেছে অ্যাজটেক সোনা৷ অবশ্য সেই চোরাই সোনার অনেকটাই বাটপাড়ি হয়ে যেত দেশে নিয়ে যাওয়ার সময়, মাঝসমুদ্রে৷ অলি গলি চোরা খাঁড়িতে ওইসব সোনার জাহাজের জন্য ওৎ পেতে বসে থাকত স্প্যানিশ হার্মাদ জলদস্যুরা৷ কখনো সেই লুটপাটের সময়, কখনো বখরা নিয়ে জলদস্যুদের নিজেদের মধ্যেই খেয়োখেয়ি করতে গিয়ে সোনা ভর্তি জাহাজ তলিয়ে যেত উত্তর অতলান্তিকের গভীর জলে৷ তারপর সেই অতল জলের গুপ্তধনের খোঁজে নতুন করে কোমর বাঁধত দুঃসাহসী নাবিকেরা৷

আমেরিকার নর্থ ক্যারোলাইনা উপকূলে এই সেদিনও, ২০০৯ সালে, সমুদ্রের গভীরে এক জাহাজের ধ্বংসস্তুপ থেকে উদ্ধার হয়েছে জলদস্যু ব্ল্যাক বেয়ার্ড-এর বেশ কিছু গুপ্তধন৷ ব্ল্যাক বেয়ার্ড অবশ্য স্প্যানিশ ছিল না, ছিল ব্রিটিশ৷ প্রথম জীবনে ব্রিটেনের রানী অ্যান-এর ভাড়াটে জলদস্যু, যার একমাত্র কাজ ছিল ফরাসি এবং স্প্যানিশ জাহাজ দেখলেই হামলা করে ডুবিয়ে দেওয়া৷ লুটের সোনা নিজের পারিশ্রমিক হিসেবে রেখে দিত ব্ল্যাক বেয়ার্ড৷

জলদস্যুদের সব সোনারই যে ভরাডুবি হয়েছে, তা নয়৷ রাশি রাশি সোনা দস্যুরা লুকিয়ে রেখেছে নির্জন, দুর্গম দ্বীপে৷ তার পর হয়তো ধরা পড়ে ফাঁসি গেছে গোটা দল, বা মাঝ সমুদ্রের লড়াইয়ে জাহাজসমেত তাদের সলিল সমাধি হয়েছে, অথবা লুটের বখরা নিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি করে মরেছে৷ অজানা দ্বীপে, সবার অগোচরে পড়ে থাকা তাদের গুপ্তধন নিয়ে গুজব ছড়িয়েছে নোনা হাওয়ায়, বন্দরের পানশালায়, বুড়ো নাবিকের আজগুবি গল্পে৷ বহু যুগ পর হয়তো হঠাৎ কেউ, কোনও কূল হারানো জেলে নৌকা বা বাপে খেদানো বাউন্ডুলে অভিযাত্রী খোঁজ পেয়েছে সেই ট্রেজার আইল্যান্ডের৷ সোনার জন্য ফের শুরু হয়েছে হুড়োহুড়ি, মারামারি৷

তবে সোনার জন্যে হুড়োহুড়ির একেবারে হদ্দ করে ছেড়েছে উনিশ শতকের আমেরিকা৷ ১৮৪৮ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার এক নদীর ধারে করাত কল বানাতে গিয়ে, নদীর বুকে সোনার খোঁজ পেলেন জেমস মার্শাল নামে এক ছুতোর মিস্ত্রি৷ দিকে দিকে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে, যে সোনা যেহেতু নদীর স্রোতে ভেসে আসা নুড়িপাথরে পাওয়া যাচ্ছে, এ সোনার মালিক কেউ নয়৷ আগে এলে আগে পাইবেন ভিত্তিতে এ সোনা পাবলিকের৷ ব্যাস, শুরু হয়ে গেল আমেরিকার ঐতিহাসিক গোল্ড রাশ৷ সারা আমেরিকা ঝেঁটিয়ে প্রায় তিন লক্ষ মেয়ে মরদ বাচ্চা ক্যালিফোর্নিয়া গিয়েছিল সোনার খোঁজে৷ সমাজতাত্ত্বিকেরা বলেন, চটজলদি পয়সা বানিয়ে নেওয়ার যে মার্কামারা মার্কিন প্রবণতা, ইজি মানি, কুইক মানি-র পিছনে বেদম ছোটা সেই মানসিকতার শুরু নাকি ওই সোনার দৌড় থেকেই৷ ১৮৪৮ থেকে ১৮৫৫, টানা আট বছর চলেছিল ক্যালিফোর্নিয়ার গোল্ড রাশ৷ চ্যাপলিন যে গোল্ড রাশ দেখিয়েছিলেন, সেটা আরও পরের ঘটনা৷ ১৮৯০ সালে, আলাস্কায়৷

ইতিহাস বলছে, উনিশ শতকের নানা সময়ে বিশ্বের নানান দেশে সোনার খোঁজে মানুষ হন্যে হয়ে ঘুরেছে৷ একই খ্যাপামো দেখা গেছে ক্যালিফোর্নিয়া ছাড়াও আমেরিকার অন্যত্র, দেখা গেছে কানাডায়, দক্ষিণ আফ্রিকায়, ব্রাজিলে, অস্ট্রেলিয়ায়৷ যেমন এল ডোরাডো৷ উপকথার যে সোনার শহর প্রায় দু শতক ধরে নিশির ডাকের মতই ঘরছাড়া করেছে ইউরোপিয় অভিযাত্রীদের৷ আসলে যদিও এল ডোরাডো বলতে স্পেনের লোকেরা বুঝত কলম্বিয়ার এক উপজাতি প্রধানকে, সাবেক এক ধর্মীয় প্রথা হিসেবে, যিনি সারা গায়ে সোনার গুঁড়ো মেখে ঝাঁপ দিয়েছিলেন হ্রদের জলে৷ এল ডোরাডো৷ সেই স্বর্ণকান্তি মানুষ৷

সারা গায়ে সোনার গুঁড়ো মেখে জলে ঝাঁপ দেওয়ার ঘটনা থেকে কি মনে পড়ল অরণ্যদেবের কিলাউয়ির স্বর্ণতট? সদ্য বিবাহিত অরণ্যদেব যেখানে নতুন বউকে সঙ্গে নিয়ে ফুলের সাজ পরে সমুদ্রে নাইতে নামতেন৷ আর ভেজা গায়ে কিলাউয়ির সোনা মেশানো বালিতে গড়াগড়ি খেয়ে, সারা শরীরে সোনার গুঁড়ো মেখে হাত ধরাধরি করে ঢুকে যেতেন মরকত কুটিরে৷ মধুচন্দ্রিমার রাত কাটাতে৷

তবে গহিন আফ্রিকার স্বর্ণতট অনেক দূরের কল্পনা৷ মধ্যবিত্ত বাঙালির, মেয়ের বিয়ের জন্য একটু একটু করে সোনা সঞ্চয় করে যাওয়া গেরস্থ বাঙালির সোনা নিয়ে প্রিয় গল্প বোধহয় আলিবাবা-র৷ বরাতের বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মনে মনে বলা, চিচিং ফাঁক৷ আর অপেক্ষায় থাকা, কবে খুলে যায় গোপন রত্নভান্ডারের দরজা৷

No comments: