কারও মনে আছে
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওই ছোট্ট গল্পটা? ভন্ডুল
মামার বাড়ি? বিভূতিভূষণ যেরকম একেবারে অতি সাধারণ লোকেদের
নিয়ে লিখতেন, এও সেরকমই একটা লোকের গল্প৷ যে লোকটা সারা জীবন ধরে সংসারের
দায়দায়িত্ব সামলে নিজের একটা বাড়ি বানানোর চেষ্টা করে গিয়েছিল৷ কিন্তু লোকটা যে
কাজেই হাত দেয়, সেটাই তো ভন্ডুল হয়ে যায়! ভন্ডুল মামা কিন্তু
হাল ছাড়ত না৷ বলত, “বুঝলে, এ বছরটায় আর পেরে উঠলাম না৷ এই তো, রান্নাঘরটা করে
ফেললে, একটা কুয়ো খুঁড়ে নিলে আর পাঁচিলটা দিয়ে নিলেই বাড়ি তৈরি৷ পরের বছর নিশ্চই
....৷”
কেমন লাগে ভন্ডুল
মামাদের, যাঁরা কোনও কাজ সারা জীবনেও ঠিক মত করে উঠতে পারেন না? কী ভাঙাগড়া চলে তাঁদের মনের মধ্যে?
হতাশা কি কখনও থামিয়ে দেয় না তাঁদের? না পারলে সত্যি সত্যিই
নিজেদের বলেন, “ঠিক আছে, পরের বার”?
সৌমিত্রদা অন্তত
তাই বোধহয় বলতেন নিজেকে৷ সৌমিত্রশংকর দাশগুপ্ত৷ (নামটা বদলে দিলাম কারণ সৌমিত্রদার
চেনা কারও চোখে পড়ে যেতে পারে লেখাটা৷) বড় অদ্ভুত মানুষ৷ প্রেসিডেন্সি কলেজে
ইংরেজির কৃতি ছাত্র ছিলেন৷ এটা সেই সময়ের প্রেসিডেন্সি যখন তারকনাথ সেন-এর মত
প্রবাদপ্রায় অধ্যাপকরা পড়াতেন৷ কোনটা কিটস-এর লাইন আর কোনটা ইয়েটস-এর, একবারে
বলতে না পারাটা ছাত্রদের কাছে লজ্জার ব্যাপার ছিল৷ সেই সময়ের গর্বিত
প্রেসিডেন্সিয়ান সৌমিত্রদা আইএএস পরীক্ষায় বসেন এবং ফরেন সার্ভিস পেয়ে যান৷ এবং
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বাকি দৌরাত্মগুলো সৌমিত্রদা বিদেশের ভারতীয় দূতাবাসের সেকেন্ড
মিনিস্টার হিসেবেই করেছিলেন৷ বহু বিচিত্র আর রোমহর্ষক সেই সব দুরন্তপনার গল্প৷
বলতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে৷ কিন্তু সে কথা বলার জন্য এই লেখা নয়৷ সৌমিত্রদার লেখক
হওয়া, বা না হওয়া নিয়ে এই লেখা৷
প্রেসিডেন্সির
ইংলিশ অনার্স হোক বা ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিস, সৌমিত্রদা সবসময়ই লেখক হতে চেয়েছিলেন৷
হয়তো এখনও চান৷ ইংরেজি ভাষার ভারতীয় লেখক৷ হতে পারে উপমন্যু চ্যাটার্জির প্রভাব৷
যদিও সৌমিত্রদা স্বীকার করতেন না৷ উল্টে বাকি লেখকদের সবাইয়ের নামে ব্যাপক
গালিগালাজ করতেন৷ কেউ নাকি লিখতে জানে না৷ বলতেন, দাঁড়াও না, আমার বইটা একবার
বেরোক৷ তারপর বুঝবে, এরা কেমন ষাঁড়ের গোবর লেখে!
অত্যন্ত দুর্মুখ
সৌমিত্রদা ভি এস নইপল, নীরদ সি থেকে অরুন্ধতি রায়, কাউকে রেয়াত করতেন না৷ বিশেষ
করে উপমন্যু, অমিতাভ ঘোষ-এর মত নতুনেরা ছিল তাঁর দুচোক্ষের বিষ৷ আর কেউ যদি একটা
প্রাইজ-টাইজ পেয়ে যেত তো আর দেখতে হত না! পুরো
চিনেপটকার সলতেয় আগুন! সারাক্ষণ চিড়বিড় করেই যাচ্ছেন৷ খুব
যে হিংসে, বিদ্বেষটা যে একেবারেই অসূয়াপ্রসুত, তা কিন্তু নয়৷ বরং যেন ছেলেমানুষের
মত অধৈর্য হয়ে পড়েছেন৷ কারণ তাঁর বই বেরোবার আগেই সবার সব বই বেরিয়ে প্রাইজ টাইজ
সব পেয়ে যাচ্ছে৷ তক্ষুনি যেন সব শেষ হয়ে যাবে! অবশ্য
সৌমিত্রদার স্বভাবটাই ছিল ওই রকম৷ ভয়ংকর ছটফটে এবং নানা ব্যাপারে রীতিমত
বাতিকগ্রস্ত৷ কাঁধে সবসময় একটা চামড়ার ব্যাগ৷ এমনকী টয়লেট গেলেও সেটা সঙ্গে নিয়ে
যেতেন৷
কী আছে
সৌমিত্রদা, ব্যাগের মধ্যে?
কী আবার! আমার লেখা৷ সব ফ্লপি ডিস্কে নিয়ে রেখেছি৷
কেন?
আরে আমি তো লিখি
কম্পিউটারে৷ সে তো বাড়িতে৷ যখন বাড়ি থাকি না, তখন যদি বাড়িতে আগুন লাগে!
একবার পড়াবেন তো
আপনার লেখা?
পড়বে? অত্যন্ত সংশয় নিয়ে জিজ্ঞেস করতেন সৌমিত্রদা৷ যেন, পড়ে যদি
বুঝতে না পারি! আর যাদেরকে উনি ততটা বুদ্ধিমান বলে মনে করতেন
না, তারা লেখা পড়তে চাইলে বলতেন, আরে দূর৷ এসব আবার লেখা৷ পড়ার আর কী আছে৷ যেন
অপাত্রে দানের মত. অযোগ্য হাতে গেলে লেখার চরিত্র নষ্ট হয়ে যাবে৷ আর যাদেরকে তাও
কিছুটা ক্ষমা ঘেন্না করে নিজের লেখা নিয়ে আলোচনার যোগ্য মনে করতেন, তাদেরকে দরকারে
মাঝ রাতেও ফোন করে জানাতেন, “বুঝলে, অরুন্ধতি রায়-এর যে লিটারারি
এজেন্ট, এই মাত্র তার সঙ্গে ফোনে কথা হল৷ বলেছে ম্যানুসক্রিপ্ট-টা পাঠিয়ে দিতে৷” সেই পান্ডুলিপি পাঠানো নিয়েও পাগলামো৷ জনে জনে ডেকে জিজ্ঞেস করছেন, “আচ্ছা এই ডিএইচএল কুরিয়ারটা ভাল না? হারিয়ে
ফারিয়ে ফেলে না তো? এ লেখা অন্যের হাতে গিয়ে পড়লে তো আবার
বিপদ! যদি মেরে দেয়!”
সৌমিত্রদার
ইন্ডিয়ান এমব্যাসির চাকরিটা এর মধ্যে গেছে৷ গেছে বলতে সৌমিত্রদাই তেজ দেখিয়ে ছেড়ে
দিয়েছেন৷ প্রাগ শহরে ভারতীয় দূতাবাসে বদলি হয়ে যাওয়ার পর সৌমিত্রদা প্রেমে পড়েছেন
এক সুন্দরী বিদেশিনীর৷ ঘোরতর প্রেম৷ সৌমিত্রদা তাকে বিয়ে করবেন৷ যেহেতু কূটনৈতিক
দপ্তরের কর্মী, বিদেশি বিয়ে করতে হলে প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি প্রয়োজন৷ সৌমিত্রদা
ক্ষেপে গেলেন৷ বিয়ে করব আমি, অনুমতি দেবে ইন্দিরা গান্ধী! রাগের চোটে চাকরিই ছেড়ে দিলেন৷ তারপর থেকে ফ্রিলান্স
সাংবাদিকতা ছাড়া কোনও রোজগার নেই৷ বউ পেশায় মনোবিদ চিকিৎসক৷ তার রোজগারেই সংসার
চলে৷ এদিকে সৌমিত্রদার সঙ্গে ফরেন সার্ভিসে যারা যোগ দিয়েছিলেন, সেই সহকর্মী
বন্ধুরা এবার একে একে পদোন্নতি হয়ে রাষ্ট্রদূত হয়ে যাচ্ছেন বিভিন্ন দূতাবাসে৷ অবশ্য
তাঁরা নিজে থেকে যোগাযোগ না করলে সৌমিত্রদা যেচে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করেন না৷ সম্ভবত
তাঁদের অনেকের কাছেই সৌমিত্রদার এই জীবনটা স্রেফ পাগলামি৷ হয়ত তাঁরা কথাবার্তায়
বলেও ফেলেন সেকথা৷ কাজেই নিজের বই বার করাটা সৌমিত্রদার কাছে ক্রমশই খুব জরুরি হয়ে
পড়ছে৷ অফিসের ক্যাফেটেরিয়ার একেবারে কোণের টেবিলে ডেকে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন,
আচ্ছা দু সপ্তাহ আগে ম্যানুস্ক্রিপ্ট পাঠালাম, এখনও কোনও খবর দিল না কেন বল তো?
স্তোক দিতে হয়, ব্যস্ত
এজেন্ট তো৷ সারাদিনে কত ম্যানুস্ক্রিপ্ট আসে! দেবে,
খবর দেবে৷ চিন্তিত মুখে সৌমিত্রদা বলেন, তাহলে এখন ফোন করা উচিত হবে না, বলো?
সাবধানে বলতে হয়,
আরও কদিন যাক না৷ সবে তো দু সপ্তাহ৷
সেই রাতেই
উত্তেজিত সৌমিত্রদার ফোন৷ “আর থাকতে পারলাম না, বুঝলে৷ ফোন করেই ফেললাম৷ বললো ওর অফিসকে
জিজ্ঞেস করে জানাবে আমার ম্যানুস্ক্রিপ্টটা পেয়েছে কিনা৷ দেখলে, আমার মনে হচ্ছিল
এই সব কুরিয়ার টুরিয়ার গন্ডগোলের ব্যাপার৷ তার থেকে সোজা লন্ডনে চলে গিয়ে হাতে
হাতে দিয়ে এলেই হত৷ এত বড় এজেন্ট৷ এর অফিসে কার হাতে গিয়ে পড়বে, কোথায় চলে
যাবে.....৷”
ফোন রেখে দিলেন
সৌমিত্রদা৷ আবার কিছুক্ষণ পরে ফোন, “ভন্টে-কে ফোন করেছিলাম বুঝলে৷ তুমি
যা বললে ভন্টেও তাইই বলল৷ আরও কিছুদিন দেখতে৷”
ভন্টে মানে
সৌমিত্রদার সেই বন্ধু, যার মাধ্যমে লন্ডনের এই ডাকসাইটে এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ৷
ভন্টে ওয়র্ল্ড ব্যাংকের বড়কর্তা, প্রেসিডেন্সির ইকনমিকস, সৌমিত্রদার ব্যাচমেট৷
দিনে তাকে ছত্রিশ বার ফোন হচ্ছে, বই নিয়ে লম্বা আলোচনা হচ্ছে৷ ভন্টে বলেছে চিন্তা
না করতে৷ এই এজেন্ট যখন পান্ডুলিপিটা দেখতে রাজি হয়েছে, কিছু একটা হবেই৷
জোর করে রসিকতা
করতে হল, তাহলে তো শিগগিরই বিখ্যাত হয়ে যাচ্ছেন সৌমিত্রদা৷ দেশের কাগজগুলোর জন্যে
একটা ইন্টারভিউ নিয়ে রাখি?
দিনকয়েক পর দেখা
হতেই সিরিয়াস মুখে বললেন, শোনো, তোমার সঙ্গে কথা আছে৷ একটু আড়ালে যেতেই বললেন,
তুমি যে সেদিন বললে না, একটা আগাম ইন্টারভিউ নিয়ে রাখবে, আমার মনে হয় সেটা নিয়েই
ফেলো৷ মানে এবার মনে হচ্ছে বেড়ালের ভাগ্যে শিকেটা ছিঁড়েই গেল৷
কেন? কিছু জানিয়েছে নাকি আপনার এজেন্ট? উৎসাহ
নিয়ে জানতে চাই৷
বলব বলব, সব বলব৷
দাঁড়াও৷ আসলে আমার একটা কুসংস্কার হয়ে গেছে৷ এত বার তীরে এসে তরী ডুবল .... !
বই যেদিন বেরোবে
সেদিন কিন্তু বড় পার্টি চাই সৌমিত্রদা৷
আরে হবে হবে৷ বড়
পার্টিই হবে৷ আমার বউ কী বলেছে জানো? পার্টি
দেওয়ার জন্য একটা কাসল ভাড়া করা হবে৷ সব খরচ ওর!
ইওরোপে অনেক
মধ্যযুগীয় দূর্গই সারিয়ে সুরিয়ে এরকম পার্টি-পরবের জন্য ভাড়া দেওয়া হয়৷ দেশের
টাকায় এক রাতের জন্য লাখ তিনেক টাকা পড়ত তখন! আরে এ
লোকটার এতগুলো বছর তেমন কোনও রোজগার নেই! বলেই ফেললাম, দূর্গ
ভাড়া করবেন? সে তো অনেক পয়সার ব্যাপার!
আরে প্রথম বই
বেরনোটা কি কম বড় ব্যাপার নাকি!
ব্যাস তারপর
ঘন্টাখানেক ধরে চলল সেই পার্টিতে কী কী খাওয়ানো হবে, কী রকম তুমুল মদ্যপান হবে,
তার গল্প৷ স্কচ-রসিক সৌমিত্রদা অন্তত মদ্যপানের ব্যাপারে কার্পণ্য করতে রাজি নয়৷ “বুঝলে, স্কটল্যান্ড থেকে সিংগল মল্ট হুইস্কির একটা আস্ত ওক কাস্ক আনাব৷ আমার
বন্ধুরা, অন্তত ইওরোপে যারা আছে, যে যেখানেই থাকুক, সবাই নির্ঘাত চলে আসবে৷ আরে
আমার প্রথম বই বলে কথা .... !”
এই ভাবেই চলতে
থাকে সৌমিত্রদার স্বপ্নের পানসি৷ হাইওয়েতে সৌমিত্রদার মান্ধাতার আমলের লজঝড়ে
ফোকসভাগেন গলফ-কে টপকে হুশ করে বেরিয়ে যায় বি এম ডাবলিউ স্পোর্টস কার৷ সৌমিত্রদা
দাঁত কিড়মিড় করে কিছুক্ষণ তাকে তাড়া করার ব্যর্থ চেষ্টা করেন৷ তার পর হাল ছেড়ে
দিয়ে, দুটো কাঁচা খিস্তি দিয়ে বলেন, দাঁড়া শালা, একদিন দেখাব তোকে৷ অর্থাৎ, বইটা
একবার বেরোক৷ সৌমিত্রদা নিশ্চিত, একবার বইটা ছেপে বেরোলে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হবে
না৷ ওটাই সব সমস্যার মুস্কিল আসান হবে৷
একদিন হন্তদন্ত
হয়ে অফিসে ঢুকলেন, “ঝুম্পা লাহিড়ি পরের বইটার জন্য সাইনিং অ্যামাউন্ট কত পেয়েছে জানো? লেখেনি এখনও৷ ভাবো একবার! এক লাইনও
লেখেনি এখনও৷ স্রেফ বলেছে পরের বইটা ওই পাবলিশারকেই দেবে৷ তার জন্যে ওই অশ্লীল
অ্যামাউন্টের টাকা!”
ধড়াস করে একটা
চেয়ারে বসে পড়েন সৌমিত্রদা৷ পরিস্কার বোঝা যায়, ওই মিলিয়ন ডলারের চেক যখন ওর নিজের
নামে কাটা হবে, তখন কী হবে সেই ভেবেই উত্তেজনায় অবসন্ন হয়ে পড়েছেন৷
সৌমিত্রদার পিছনে
অনেকেই যদিও হাসাহাসি করে৷ কারণ তারা তো সৌমিত্রদাকে প্রথম দেখছে না৷ এই বই বেরনোর
গল্প অনেকদিনের৷ প্রায় প্রত্যেকেই একবার না একবার সৌমিত্রদার স্বপ্ন ভাগ করে
খেয়েছে৷ বিশ্বাস করেছে, সত্যিই বই বেরোবে৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনও প্রকাশকই আর
সৌমিত্রদার লেখা ছাপেনি৷ দু একজন এজেন্ট, কেন কে জানে, প্রথম প্রথম খুব উৎসাহ
দেখিয়েছে৷ কেউ হয়ত বলে পাঠিয়েছে, অমুক আর অমুক চ্যাপ্টারটা যদি একটু বদলানো যায়
...৷ উন্নাসিক, নিজের লেখালেখি নিয়ে অতি মাত্রায় স্পর্শকাতর সৌমিত্রদা সুবোধ
বালকের মত সেই প্রস্তাবে সায় দিয়েছে৷ রাত জেগে লিখে এজেন্টের ‘পরামর্শমত পরিবর্তিত’ নতুন পরিচ্ছেদ এক
সপ্তাহের মধ্যে কুরিয়ার করে পাঠিয়ে দিয়েছে৷ তারপর অপেক্ষায় থেকেছে৷ পরিচিত লোকজনের
কাছে ছোট বাচ্চার মত জানতে চেয়েছে, “কী হল বলত? কিছু তো জানাল না! যেরকম বলল, সেরকমই তো
লিখে পাঠিয়ে দিলাম ... !”
কিন্তু সেই হয়
না, বারবার অপমানের ঢোঁক গিলে পাত্রপক্ষের সামনে সেজেগুজে বসতে হয়, আর তারা চা-শিঙাড়া
খেয়ে ঢেকুর তুলতে তুলতে পরে খবর দেব বলে চলে যায়, ঠিক তেমনটাই যেন হচ্ছিল
সৌমিত্রদার সঙ্গে৷ খবর আর আসে না৷ কিন্তু হাল ছাড়ে না সৌমিত্রদা৷ আরও নতুন লেখা
মাথায় আসছে৷ মহা উৎসাহে সেই নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে৷ “বুঝলে, এবার ভাবছি একটা খুব হাল্কা লেখা লিখব৷ নাম দেব, পাপায়া লেন৷ পেঁপে
গলি৷ সাহেবরা তো এরকম রাস্তার নাম জীবনে শোনেনি৷ আরে আমি যেসব অভিজ্ঞতার মধ্যে
দিয়ে গেছি, তোমার এসব ঝুম্পা-টুম্পা তো ভাবতেও পারবে না...৷”
শুরু হল পেঁপে
গলির গল্প৷
এই করতে করতেই একদিন
আমার বিদেশবাসের মেয়াদ ফুরলো৷ দেশে ফেরার আগে বলে গেলাম, সৌমিত্রদা, বই বেরোলে খবর
দিও কিন্তু৷
আরে সে আর বলতে৷
কিন্তু আমি খবর দেওয়ার আগেই দেশে খবর চলে যাবে না মনে করছো!
কেন কে জানে,
একটু খারাপই লাগল৷ এখনও লোকটা প্রাণপণে বিশ্বাস করছে যে বই বেরোলে এতটাই বিখ্যাত
হবে যে নিজে খবর দেওয়ার আগেই মিডিয়া-ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে খবর পৌঁছে যাবে দিগদিগন্তে৷
কলকাতায় তো বটেই৷
আট বছর পর আবার
দেখা হল সৌমিত্রদার সঙ্গে৷ বিদেশেই৷ এর মধ্যে হয়তো দেশে এসেছে, কিন্তু কোনও
যোগাযোগ করেনি৷ নুন-মরিচ চুলে নুনের ভাগ আরেকটু বেড়েছে, আরেকটু ওজনও বেড়েছে৷
এছাড়া তেমন কোনও পরিবর্তন নেই৷ হয়তো নিজে থেকে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল না, কিন্তু
প্রথমেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, সৌমিত্রদা, বইয়ের কী হল?
আরে দূর, ছাড়ো৷
আমার লেখা, সেই নিয়ে আবার বই৷
এর পর আর
কথাবার্তা তেমন এগোল না৷ আর এক বন্ধু হাত ধরে টেনে পাশে সরিয়ে নিলেন৷ বইয়ের কথা আর
জিজ্ঞেস কোরো না৷ ইদানীং এত লোকে পেছনে লাগছিল যে বইয়ের কথা নিজেই আর বলে না৷ তুমি
জিজ্ঞেস করলে হয়তো ভাববে তুমিও ব্যাঙ্গ করছ৷
এখন তো দেশে অনেক
প্রকাশক ইংরেজি বই ছাপায়৷ বরং দেশে একবার চেষ্টা করলে পারত৷
দূর৷ কে ছাপাবে
ওর বই! চল্লিশ বছর আগে দেশ ছেড়েছে৷ তখনকার চোখ
দিয়ে দেখা ওর দেশ সম্পর্কে এখন কে আর জানতে আগ্রহী হবে বলতো?
তাও হয়তো চেষ্টা করতে পারত৷ কিন্তু দেশেই তো যায় না৷
সে কি, এই আট
বছরে একবারও যায়নি!
নাঃ৷ এমনকী যখন
বাবা মারা গেল, তখনও যায়নি৷ বলল, “বাবা-কে কথা দিয়েছিলাম, নিজে হাতে
করে আমার বই দিয়ে আসব বাবাকে৷ সেটাই যখন হল না, আর গিয়ে কী হবে৷” ওর বউ অনেক বুঝিয়েছিল৷ শোনেনি৷
এখনও ভাবে, বই
ছাপানোর কথা?
জানি না৷ বলে না
তো আর৷ তবে ওই যে বললাম৷ ওর লেখার স্টাইল, লেখার বিষয়, ওর দেখার চোখ. সবই তো অনেক
পুরনো হয়ে গেছে৷ পাঠক পাওয়া, প্রকাশক পাওয়া, সবই মুশকিল৷
মনে পড়ল ভন্ডুল
মামার বাড়ি৷ ভন্ডুল মামা শেষপর্যন্ত মাথা গোঁজার মত একটা আস্তানা বানিয়ে উঠতে
পেরেছিলেন৷ কিন্তু ততদিনে ম্যালেরিয়া আর ডেঙ্গুর জ্বালায় সেই গ্রামে আর কেউ থাকে
না৷ সন্ধে হলেই নিঝুম অন্ধকার নেমে আসে৷ সব পোড়ো বাড়ি, আগাছার জঙ্গল, ভাঙা
দরদালানে শেয়ালের হাঁকাহাঁকি৷ ভন্ডুলমামা তাও থাকতেন৷ বউ ছেলেরা কেউ সেই পাগলামিতে
সায় দেয়নি, থাকতেও আসেনি৷ ভন্ডুলমামা একাই থাকতেন৷ একেবারে একা একা৷
এক বন্ধুর সঙ্গে
কথা হচ্ছিল সৌমিত্রদার মত ভন্ডুলমামাদের নিয়ে৷ সময় পেরিয়ে যায়, দিন ফুরিয়ে যায়,
কিন্তু যাদের আশা ফুরোয় না৷ বন্ধু বলল, আসলে আমরা সবাই তো এক একজন ভন্ডুলমামা৷ সময়
চলে যায়, কোনও কাজই হয়ে ওঠে না৷
তাই কি? ভন্ডুলমামারা কি আদৌ বুঝতে পারে যে তারা সময়ের থেকে পেছিয়ে
পড়ছে? নাকি নিজেদের চিন্তা-ভাবনার একটা কোকুন-এর মধ্যে,
গুটিপোকার মত থেকে যায়? আর সব সময় ভেবে চলে যে একদিন
প্রজাপতি হয়ে গুটি কেটে বেরিয়ে যাবে? আসলে এরকম সহজ সরল কোনও
তত্ত্ব বোধহয় খাড়া করা যায় না৷ বন্ধু বলল আর একজনের কথা৷ ধরে নেওয়া যাক, তার নাম
সূর্য ঘোষ (এবারেও নাম বদলে দিতে হল)৷ কলকাতার দক্ষিণ প্রান্তের বাসিন্দা সূর্য
একটা খবরের কাগজ চালান৷ চার পাতার কাগজ৷ সাপ্তাহিক৷ নাম, (ধরে নেওয়া যাক) ‘সংবাদ সূর্য’৷ কাগজের নামের সঙ্গে নিজের নামটাও জুড়ে
দেওয়া থেকেই পরিস্কার, সূর্য কী চান৷ সূর্য চান, লোকে তার কাগজটা পড়ুক৷ কাগজটার
নামডাক হোক. সেই সঙ্গে তাঁরও৷ এই কাগজের মালিক, সম্পাদক, সাংবাদিক, প্রকাশক,
মুদ্রক, মায় ফিরিওলাও সূর্য নিজে৷ সূর্য একাই, আর কেউ নেই সঙ্গে৷ সকাল থেকে নিজেই
সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন সংবাদ সংগ্রহে৷ তারপর দুপুর নাগাদ একটা ডিটিপি-র ঠেক আছে
জানাশোনা, সেখানে গিয়ে নিজেই কম্পোজ করেন, নিজেই পেজ ডিজাইন করেন৷ সংবাদ সূর্য-র
খবরের চরিত্র বেশ অদ্ভুত৷ প্রথম পাতায় হয়ত বড় করে কাশ্মীরে পুলিশ – জনতা খণ্ডযুদ্ধের খবর, তার ঠিক নিচেই স্থানীয় পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ী
সমিতির কোনও সচিত্র সংবাদ৷ তার ঠিক পাশেই কোনও নায়িকার খুল্লমখুল্লা একটা ছবির
সঙ্গে তার বিবাহবহির্ভূত প্রেমের কেচ্ছা-কাহিনি৷ একেবারে সাড়ে বত্রিশ ভাজা৷ কাগজের
দাম এক টাকা, মাত্র৷ তাও বিক্রি হওয়া মুশকিল৷ তাই খবরের কাগজের হকারদের বিনে পয়সায়
কাগজ দেন সূর্য৷ বলে দেন, যদি বিক্রি হয়, তাহলে যা পয়সা হবে, সব ওদের৷ হকারদের৷
সূর্যর বিশ্বাস, এভাবেই একদিন ওর কাগজটা জনপ্রিয় হবে৷ লোকে পয়সা দিয়ে কিনে পড়বে৷
বিজ্ঞাপন আসবে৷ ফ্রি নয়, পয়সা দিয়ে ছাপানো বিজ্ঞাপন৷ এক দুপুরে চা খেতে খেতে সূর্য
শুনিয়েছেন ওর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা৷ সংবাদ সূর্য যেদিন বড় হবে, বেশ নামডাক হবে (একদিন
হবেই৷ সূর্যর বিশ্বাস), সেদিন কাগজের নিজস্ব একটা অফিসঘর হবে৷ বেশ নিজের একটা
অফিস, কয়েকজন কর্মী৷ হকারদের তখন আর সাধতে হবে না৷ তারা নিজেরাই এসে কাগজ নিয়ে
যাবে৷ আস্তে আস্তে সাপ্তাহিক থেকে দৈনিক হবে ‘সংবাদ সূর্য’৷
বন্ধু বলল, হাসি
পায়নি৷ খুব মায়া হয়েছিল লোকটার ওপর৷
আমাদের কত আফশোস
থাকে, তাই না! সেদিনই এক অবসর নেওয়া আমলার সঙ্গে আলাপ হল,
যিনি সেই কোন যুবক বয়েস থেকে একটা বাউল গানের দল চালান৷ বাউলের সাজে নিজের ছবি
দেওয়া কার্ড ছাপিয়েছেন! বলেও ফেললেন, আমার তো অন্য ‘লাইনে’ যাওয়ার কথা ছিল৷ শুনে মনে পড়ে গেল
শান্তিনিকেতনের ট্রেনে আলাপ হওয়া সেই বাউলকে৷ ভাব জমাতে গায়ে পড়ে দেওয়া সিগারেটে
গাঁজার ছিলিমের টান দিয়ে যে বলেছিল, মাঝে মাঝে মনে হয় এসব কী গান শোনাই, কারে গান
শোনাই! পেটের খিদে মেটে না, শীতে গায়ে কাপড় থাকে না৷ তার
থেকে দাও বাবা একটা সরকারি চাকরি, দোতারা চুলোয় গুঁজে রোজ দশটা-পাঁচটা করি! আমার বিস্মিত চাহনি দেখে সে বলেছিল, অবাক হয়ো না বাপ৷ তেমন বাউল আর হতে
পারলাম কই!
সারা জীবন আফশোস
করে মরার থেকে ভন্ডুলমামা হওয়া ভাল? বার বার
মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়েও আবার ধুলো ঝেড়ে উঠে পড়া? নিজেকে
বোঝানো, আজ হয়নি, কিন্তু কালকে? কাল তো আস্ত একটা নতুন দিন!
No comments:
Post a Comment